শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

মোদির বাংলাদেশ সফর ও উত্তপ্ত রাজপথ

মোদির বাংলাদেশ সফর ও উত্তপ্ত রাজপথ

মোদির বাংলাদেশ সফর ও উত্তপ্ত রাজপথ

মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ, ২০২১

 

 

৩০৪ বার পড়া হয়েছে

প্রিয় পাঠকঃ২৬ শে মার্চ ঢাকা আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের প্রধান অতিথি। তার আগমনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় যার ফলে উৎসব উদযাপনের পরিকল্পনাটি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। মোদি বিরোধী বিক্ষোভে কমপক্ষে ১০ জন মারা যান এবং কয়েক ডজন মানুষ আহত হন। বাংলাদেশ সরকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সারাদেশে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিবি) মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। বিক্ষোভকারীদের সহজে সমবেত হওয়া রোধ করতে ফেসবুক এবং মেসেঞ্জার অ্যাপের ‘অ্যাক্সেস’ও সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়।

সোমবার তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড এ ঢাকা ভিত্তিক সাংবাদিক ফয়সাল মাহমুদের এক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়ঃ

মোদির সফরের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দৃশ্যমান হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগেই যখন রক্ষণশীল দল ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো রাজধানী ঢাকায় একাধিক সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিক্ষোভকারীরা ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটের দাঙ্গায় মোদির ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেন। ওই দাঙ্গায় কমপক্ষে ১০০০ লোক মারা গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান।
ঢাকার বিক্ষোভকারীরা জম্মু ও কাশ্মীর, নয়াদিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির জন্যও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ২৬ শে মার্চ যেদিন মোদি বাংলাদেশে পা রাখেন, সেদিন তিনটি জেলায় জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠেঃ ঢাকা, ভারতের সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং উপকূলীয় চট্টগ্রাম। নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায় যাতে কমপক্ষে ১০ জন নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হন।

মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো কি ভুল ছিল, এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চেষ্টা করা হয়েছে টিআরটি ওয়ার্ল্ড এর ওই প্রতিবেদনেঃ

১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে৷ যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রায়শই দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা “প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কের উৎকৃষ্ট উদাহরণ” হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর তার সুস্পষ্ট হিন্দু জাতীয়তাবাদী অবস্থানের পর সে সম্পর্কে ফাটল দেখা গেছে। তখন থেকেই, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদি বিরোধী কন্ঠের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাকে প্রশমিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন, যারা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) প্রয়োগের মতো বিভিন্ন বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মোদি সরকারকে আক্রমণ করে কথা বলেন। এনআরসি এবং সিএএ দুটিকেই ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত বৈষম্যমূলক বলে বিশ্বাস করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মোদিকে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমন্ত্রণ জানানো ‘সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না’ মন্তব্য করে বলেন, “স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পাশাপাশি আমরা আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীও উদযাপন করছিলাম যিনি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি গঠনে সংগ্রাম করে গেছেন।যেখানে মোদি সহজাতভাবেই সাম্প্রদায়িক। তিনি [মোদি] তার কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী অবস্থানের কারণে নিজ দেশেও সমালোচিত। এর পাশাপাশি, দীর্ঘ-বিতর্কিত তিস্তা নদীর জল-ভাগাভাগির চুক্তি এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা সহ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি অমীমাংসিত ইস্যু বহু সংখ্যক মানুষকে এমনিতেই মোদি এবং ভারতের বিরুদ্ধে যেতে প্ররোচিত করেছে।”

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের সাথে কথা বলতে গিয়ে ধর্মীয় ইস্যুতে জনপ্রিয় বাংলাদেশী ব্লগার আসিফ সিবগাত ভূঞা বলেন, রক্ষণশীল এবং বামপন্থী উভয় দলই একেবারে ভিন্ন ভিন্ন কারণে মোদির সফরের প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশের ধর্মীয় রক্ষণশীলদের দ্বারা মোদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করা বেশ প্রত্যাশিত ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার দিন থেকেই মোদি এবং তার দল খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিম বিরোধী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। এর স্বপক্ষে এতো সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।”

বামপন্থী দলগুলোর প্রতিবাদ কিছুটা কম চোখে পড়েছে উল্লেখ করে আসিফ বলেন, ‘উদার পশ্চিম’ এ, যেখানে রাজনৈতিক অধিকারের সংজ্ঞাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং মুক্ত-বাজার উদারপন্থী নীতির সমন্বয়ে গড়ে উঠে; সেখানে ভারতে এখন এটি বিজেপির নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ভারতের বামপন্থীরাও যার বিরোধী। বাংলাদেশি বামপন্থীরা ভারতীয় বামপন্থীদের ‘প্রাকৃতিক সহযোগী’ এবং ধর্মীয় উগ্রতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তারা সহমত পোষণ করে যা তাদের চোখে উপমহাদেশীয় অভিজ্ঞতায় পুঁজিবাদী শ্রেণীকে টিকিয়ে রাখার একটি আদর্শিক কার্ড।”

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় প্রতিবেদনটিতে জার্মান ভিত্তিক বাংলাদেশী রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিয়া হাসানের বক্তব্য নেয়া হয়। মোদি এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফর করলেও তখন এরকম প্রতিবাদ হয়নি স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিয়া বলেন, “প্রশ্ন আসে: তাহলে কি বদলেছে?”

“জনগণের প্রচলিত মত হ’ল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরম অজনপ্রিয় সরকার কেবল ভারতের সমর্থনের কারণে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে। ২০১৪ সালে, যখন শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেকেরও বেশি আসন নির্ধারিত হয়ে যায় (যা ছিল প্রহসনের চেয়েও বেশি), তখন ভারত হাসিনাকে সমর্থন করেছিল এবং নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এতে হাসিনার ক্ষমতায় থাকতে পারাটা নিশ্চিত হয় এবং নতুন সরকারের বৈধতা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিরক্তি প্রকাশও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৯ সালে আরেকটি নির্বাচনে শেখ হাসিনা ভূমিধ্বস বিজয় (৩০০ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন) পেয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু নির্বাচনটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। শেখ হাসিনা ব্যাপক কারচুপি, বিরোধী দলের কর্মীদের ভয় দেখানো এবং ব্যাপক সহিংসতার অভিযোগের সম্মুখীন হন। আগের মতো ভারত আবারো শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন করে এবং তিনি শক্তভাবে টিকে যান।”

জিয়া টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলছিলেন, “লক্ষণীয় বিষয় হ’ল হাসিনা কেবল ভারতের সমর্থনের কারণে নয়; বরং তিনি ভারতে, পশ্চিমে এবং বাংলাদেশী অভিজাতদের মধ্যে নিপুণভাবে বাংলাদেশের সম্পদ বিভক্ত করতে পেরেছেন বলেই ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয়েছেন।”

তবে বেশিরভাগই এই ধারণাকে গ্রহণ করেন না মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষতিসাধন এবং আন্তর্জাতিক বৈধতার অভাব স্বত্ত্বেও এই সরকারের টিকে থাকার জন্য তারা মূলত ভারতকেই দায়ী মনে করেন। একই সাথে, ভারতের নাগরিকত্ব ইস্যু থেকে শুরু করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির বক্তৃতার মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশিদের জন্যও অবমাননাকর। সেই সাথে শেখ হাসিনা কোন প্রাপ্তি ছাড়াই ভারতকে সমস্ত দর কষাকষির বিষয়গুলো ছেড়ে দিলেও ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে ক্রমাগত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। এসবকিছুই বাংলাদেশে মোদি বিরোধিতার কারণ। সবমিলিয়ে দ্রুত বর্ধমান ‘এন্টি ইনকামবেসি সেন্টিমেন্ট’ এর মধ্যে মোদি বাংলাদেশ সফর করেন। যার ফলে বামপন্থী দল এবং ইসলামপন্থী উভয়ই মোদির সফরের বিরোধিতা করছে।”সূএঃ মানবজমিন

ট্যাগ :

আরো পড়ুন