শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

একজন অরুণ দাশগুপ্ত

একজন অরুণ দাশগুপ্ত

একজন অরুণ দাশগুপ্ত

শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১

 

 

৭১৩ বার পড়া হয়েছে

জীবন সায়াহ্নে এসে কিংবদন্তি শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক,সমাজসেবী অরুণ দাশগুপ্তের জীবন কাটছে চট্টগ্রামের পটিয়ায় অসহায় অবস্থায়।আমরা কি পারি না গুরুতর অসুস্থ অরুণ দাশগুপ্তের পাশে দাঁড়াতে…..
অরুণ দাশগুপ্ত সম্বন্ধে বলে শেষ করা যাবে না চট্টগ্রামের পটিয়ায় জমিদার পরিবারে জন্ম নেয়া এই মানুষটি কলকাতা থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার পর দেশমাতৃকার সেবায় ফিরে আসেন নিজ ভূমি চট্টগ্রামে।কিংবদন্তি অরুণ দাশগুপ্ত চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামে করেছেন শিক্ষকতা।
অরুণ দাশগুপ্ত যেমন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন প্রত্যন্ত গ্রামের হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীকে তেমনি বাংলা সাহিত্যের অবদানে কাজ করেছেন আজীবন করেছেন সাংবাদিকতা অবদান রেখেছেন বাংলা ভাষা আন্দোলনে।দেশ মাতৃকার সেবায় আজীবন নিয়োজিত এই মানুষটি সংসার বাঁধেননি।থেকেছেন অকৃতদার।
অরুণ দাশগুপ্তের জন্ম ব্রিটিশ শাসনের গত শতকের ত্রিশের দশকে।
ততদিনে চট্টগ্রাম বিপ্লবের মহানায়ক মাষ্টার দা সূর্যসেনকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছে।উপমহাদেশের প্রথম নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা আত্মাহুতি দিয়েছেন। মাষ্টারদার রিপাবলিক আর্মির কর্মকান্ড কিছুটা স্তিমিত।চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামের কিশোর যুবকদের ওপর নজর রাখার জন্য স্থাপিত ক্যাম্পটি তখন সক্রিয়।সে সময়েই জমিদার যশোদা নন্দন ওয়ার্দাদার( দাশগুপ্ত) এর পুত্র অবিনাশ ওয়ার্দাদার(দাশ গুপ্ত) র ঘর আলো করে এলেন এক ফুটফুটে শিশু।শিশু সন্তানটির মা বাবা ও কাকা আরেক বিপ্লবী ভেবেচিন্তে আদর করে নাম রাখলেন অরুণ।তাঁদের আশা ছিল এই সন্তানটি একদিন সত্যি সূর্যের মত আলো ছড়াবে। আর তাই বাড়ির কাছে চট্টগ্রামের ধলঘাট স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়।সেখানেই তাঁর মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সমাপ্ত করলেন।এ সময় অরুণ দাশগুপ্ত যেমন সাহিত্যমনস্কতার জন্য জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ি, শান্তনিকেতন আর জীবনানন্দের ক্লাসে ঘুরঘুর করতেন তেমনি বামপন্থী রাজনীতির জন্য ঐসব দলের মিটিং মিছিলে হাজির থাকতেন কাজ করতেন।
কিন্তু এর মধ্যে অরুণ দাশগুপ্তের বাবা অবিনাশ দাশগুপ্ত দেশভাগের টানাপোড়নে কলকাতার পাঠ চুকিয়ে দেশের বাড়িতে চলে এলে অরুণ দাশগুপ্ত তাঁর সংগী হন। তাঁর মনে হতে থাকে যতই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হোক জন্মভূমির টান উপেক্ষা করা যায় না।অরুণ দাশগুপ্ত ভাবলেন,
যে দেশে জন্মেছি,
আমি সে দেশে থাকিব,
সে দেশ ভজিব।
এভাবে কলকাতার পরিচিত সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে এলেন আপন মাটিতে। ততদিনে পারিবারিক জৌলুস কমেছে। জমিদারি বিলোপের ঘটনায় হাতছাড়া হয়েছে বিপুল সম্পদ।তবু যা ছিল তা দিয়ে পায়ের ওপর পা রেখে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারতেন।কিন্তু তিনি তা করলেন না।গ্রহন করলেন শিক্ষকতার মহান পেশা। চট্টগ্রামেরই একটি উপজেলা মিরেরশরাইয়ের গ্রামের এক উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখানে কাটিয়ে দিলেন অনেকগুলো বছর। সাহিত্য প্রেমিক অরুণ দাশগুপ্ত সেসময়গুলোতেও ডুবে থাকতেন বিশ্বের খ্যাতনামা লেখকদের গ্রন্থে। সম মনস্ক লোকদের সাথে মেতে উঠতেন আড্ডায়। বেশিরভাগক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। এর মধ্যে হরেন্দ্রনাথ দে নামের এক মেধাবী ব্যক্তি তাঁর সেই স্কুলে সতীর্থ হয়ে এসেছিলেন। তাঁর সাথে ভালই সময় কাটত তাঁর।ঐ শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন পত্রিকায় চাকরি নেবার। এর মধ্যে তাঁর পরিচয় হয়েছিল দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহম্মদ খালেদের সাথে। খালেদ সাহেব দৈনিক আজাদীকে একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে রূপান্তরে গভীর মনযোগ দিয়েছেন। একে একে তিনি অনেক যোগ্য মানুষকে যুক্ত করেছেন আজাদীর সাথে। আজাদী তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ও সংগ্রামে চট্টগ্রাম তো বটেই গোটা দেশে ইতোমধ্যে সুনাম অর্জনে সক্ষম হল। অরুণ দাশগুপ্তের মত গুণী ব্যক্তিকে পাশে পেয়ে অধ্যাপক খালেদ আজাদীর সাহিত্য পাতা খুলে বসলেন।খুব দ্রুততম সময়ে আজাদীর সাহিত্যপাতা চমক দিতে সক্ষম হল অরুণ দাশগুপ্তের নিবিড় পরিচর্যায়।
তখন রবিবার এলেই আজাদীর সাহিত্যপাতা ভরে উঠতে থাকল, কবিতা গল্প প্রবন্ধে। লিটল ম্যাগের সেই স্বর্ণ যুগে চট্টগ্রামে সংযোজিত হল এক নতুন অধ্যায়। যাঁরা গাঁটের পয়সা খরচ করে লিটল ম্যাগ বা নিজের বই প্রকাশ করতে পারছিলেন না তাঁরা ও স্বপ্ন দেখলেন নিজের ভাবনা চিন্তার প্রকাশ ঘটাবার। পাঠক সমাজতো উপকৃত হচ্ছিলই নবীন লেখকদের পাশাপাশি দেশ বিদেশ আর জাতীয় ভাবে খ্যাতিমানদের লেখা আজাদীর পাতায় পেয়ে। অরুণ দাশগুপ্ত কেবল আজাদীর সাহিত্যপাতা দেখতেন এমন নয়।তিনি সময়ে সময়ে সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় ও লিখতেন। এছাড়া তাঁর নন্দন কাননের বাসাটি হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সেবকদের প্রিয় আড্ডা কেন্দ্র। কি সকাল কি দুপুর কি সন্ধ্যা আড্ডা বসত সেই কেশব সেনের নীচতলার ঘরটিতে।এখন এটি কল্যাণী এপার্টমেন্টে।সে অন্য গল্প। এখানেই তাঁর উদ্যোগে বসতো বুধসন্ধ্যার আসর। এখানে আসতেন নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ। দেশের খ্যাতনামা সাংবাদিকরা, বুদ্ধিজীবিগণ। নমস্য ওয়াহিদুল হক, ইকবাল ছোবহান সহ অনেকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে তাঁর সে ছোট্ট আড্ডাখানায়। বুধসন্ধ্যা রীতিমত জমে উঠত। এ আড্ডায় বরাবরের মতো রবীন্দ্রনাথ অন্যতম বিষয় হত আলোচনার। চট্টগ্রামের একদা পরিচিত কবি নবীন চন্দ্র সেন কবি ভাস্কর শশাঙ্ক মোহন সেনও আলোচিত হতেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী ড: অনুপম সেন যখন প্রায় নিয়মিত ভাবে অরুণ দাশগুপ্তের বাসায় আড্ডা দিতে শুরু করলেন তখন আড্ডার বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি ক্রমশ বাড়তে শুরু করল। দিনে দিনে আড্ডার লোকজনও বদলাল।
বলে রাখা দরকার অরুণ দাশগুপ্ত কিন্তু কবিতা লিখেছেন প্রচুর। লিটল ম্যাগে।নিজের পত্রিকাতে কিছুতে নয়। প্রবন্ধ লিখেছেন অসংখ্য নবীন চন্দ্র সেন এবং রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। রবীন্দ্র সমগ্র তাঁর নখ দর্পনে থাকলেও তিনি বলছেন,
রবীন্দ্রনাথের গানকে বোঝা না গেলে রবীন্দ্রনাথকে বুঝে ওঠা মুস্কিল।
তাই বুঝি নবীন চন্দ্র সেনকে নিয়ে বের করা গ্রন্থটির পর তিনি বের করতে রাজী হলেন, “রবীন্দ্রনাথের ছয় খতুর গান ও অন্যান্য “গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটি পড়লে বোঝা যাবে কতটা গভীরতা তাঁর সাহিত্যে, শিল্পে, সংগীতে। এক কথায় তিনি কেবল সাহিত্য সম্পাদক নন তিনি একজন রবীন্দ্রবোদ্ধা, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, কবি।
আজ তিনি নিঃসঙ্গ।মনে হয় সাহিত্যঅন্ত প্রাণ এই মহান ব্যক্তিটি নিজের সংসার গড়েননি পরের কথা ভেবে ভেবে।সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত থাকা পড়ে থাকাও কম দায়ী নয় তাঁর এই নিঃসঙ্গতার জন্য। এতটাই স্বার্থ অচেতন তিনি কখনো ভাবেননি পূর্বপুরুষের সম্পদ নিয়ে।কিভাবে কোথায় হারিয়ে গেল বিশাল সম্পদ কেউ জানে না। না একটু ভুল হল। কিছু দান করেছেন।কিছু হাতছাড়া হয়েছে নানা কারণে। এখন তাঁর অতিবৃদ্ধকাল। নব্বই ছুঁই ছুঁই। অনেকটা নিজের বাড়িতেই আছেন নিজের বাড়ির মত করে। নারায়ন দে নামক এক ভদ্রলোক ও তাঁর পরিবার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা ভালবাসায় দেখভাল করছেন এই অকৃতদার ত্যাগী দেশের সর্বজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সাহিত্যসেবী, কবি, প্রাবন্ধিক মানুষটির।আর কেউ থাকুক না থাকুক নারায়ন দেরা আছেন, থাকবেন।কারণ তাঁরা আপন, আপন হয়ে আছেন থাকতে জানেন।
আমরা কি পারিনা গুরুতর অসুস্থ অসহায় কিংবদন্তি অরুণ দাশগুপ্তের দাশগুপ্তের পাশে দাঁড়াতে।
লেখকঃ পটিয়া চট্টগ্রাম।

ট্যাগ :

আরো পড়ুন