প্রিয় পাঠকঃরাজপথ তাকে ডেকেছে আয়, আয়। ষ্টিয়ারিং তাকে টেনেছে কাছে, আরো কাছে। মিছিল শ্লোগান নিয়েছে জনতার কাতারে। কখন কোন ফাঁকে ডিজেল পোড়া হাতে উঠে এসেছে কলম। নিরবে-নিভৃতে থেকে অবশেষে লোকালয়ে এসেছেন মকবুল আহমদ। বৃটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশÑ এই ত্রিকাল পরিদর্শী আটান্ন বছর বয়সী শ্মশ্রæমÐিত মানুষটি জন্মেছেন ১৯৩৭ সালে এদেশেরই এক সাধারণ কৃষক পরিবারে। ৫০ সালে বাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আশ্রয় মিলেছিল নানা জায়গায়। ট্রাক দেখে সখ জেগেছিল চালক হবার। সেই থেকে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরবের পথ থেকে পথে চালিয়েছেন ট্রাক, ট্রেইলার, ট্যাংক লরী, প্রাইভেট কার, স্কুটার। আশিরদশকে জড়িয়ে পড়েন পরিবহন শ্রমিক রাজনীতিতে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, ট্যাংক লরী ড্রাইভার এ্যান্ড এসিসট্যান্ট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ ৩৮ বছরের লদ্ধ অভিজ্ঞতায় ড্রাইভার-হেলপারদের সামাজিক মর্যাদা প্রদানসহ পরিবহন শিল্পের সমস্যা সমাধানে এখনো সোচ্চার। বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লিখেছেন ও। আমৃত্যু লড়াইয়ে সংকল্প বদ্ধ মকবুল আহমদ।
কেবলই ধোঁয়া কালো ধোঁয়া
এতসব তৎপরতার পর খোদ ঢাকায় কালো ধোঁয়াসম্পন্ন গাড়ী চলাচল বন্ধ হয়নি। রাজধানীসহ দেশের প্রধান নগরীগুলো ও বড় শহরে কালো ধোঁয়া বের হওয়া মোটরযানের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, এটা সত্য। আইনের অপর্যাপ্ততা এবং অন্যান্য জটিলতার কারণে দায়ী যানগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় না Ñ বলে থাকেন কর্তৃপক্ষ। মোটরযান অধ্যাদেশ ’৮৩ অনুযায়ী যানবাহনের দূষণ রোধে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তৎপরতা চালাতে সক্ষম হয়নি। ট্রাফিক পুলিশেরও যেন এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া বের হওয়া যানের সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে জনজীবনে গভীর সংকট সৃষ্টি হবে। হৃদরোগ, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানা ধরনের স্নায়বিক রোগসহ নাগরিকদের দৈহিক ও মানসিক বিবিধ বৈকল্য বাড়বেই। পেট্রোল গাড়ির ধোঁয়া থেকে নির্গত হয় কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, সীসা ও অন্যান্য বস্তুকণা। ডিজেল গাড়ী থেকে নির্গত হয় নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং অধিক পরিমাণে বস্তুকণা, যার মধ্যে কার্বন- কণা প্রধান। সালফার অক্সাইডসমূহ, বিশেষত সালফার ডাই-অক্সাইড উভয় ধরনের গাড়ী থেকে উৎপন্ন হয়ে বাতাসে মেশে। তবে ডিজেলচালিত গাড়ী থেকে নির্গমনের মাত্রটা বেশি। বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের আশি শতাংশ ও হাইড্রোকার্বনের ষাট শতাংশ আসে শুধুমাত্র মোটরযান থেকে। সরকারী হিসেব অনুযায়ী ’৯৪ সাল পর্যন্ত দেশে যান্ত্রিক গাড়ীর সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজারের মতো।
গাড়ীর কালো ধোঁয়ার জন্য দায়ী কে? একটি গাড়ী ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া রাস্তায় আসতে পারে না। গাড়ীর ফিটনেস পরীক্ষা নিয়ে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৬০ হাজার মোটরকার, জিপ ও মাইক্রোবাসের মধ্যে ফিটনেস সার্টিফিকেট রয়েছে ’৯৪ সালের হিসেবে ২১ হাজার ৯ শ’ ৮২ টির। চলাচলকারী প্রায় ২৪ হাজার বাস ট্রাক মিনিবাসের মধ্যে ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে মাত্র ৫ হাজার ৬ শ’ ৯২ টির। ২০ হাজার চলাচলকারী টেম্পো, মিশুক, বেবী ট্যাক্সির মধ্যে ৮ হাজার ৫শ’টির ফিটনেস সার্টিফিকেট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তত্ত¡াবধান ও পরিদর্শন ব্যবস্থায় ত্রæটি, লোকবলে অপর্যাপ্ততা ও দুর্নীতিজনিত কারণে যান্ত্রিক যানবাহনের ফিটনেসের ক্ষেত্রে অনিয়ম বেড়েই চলেছে। তাছাড়া রিকন্ডিশন্ড গাড়ী ও যন্ত্রাংশ আমদানীকারকদের একটি অসাধু চক্রের ষড়যন্ত্র ও রয়েছে সেই সঙ্গে। তাই কালো ধোঁয়ার জন্য গাড়ীর মালিক ও চালক দায়ী হতে পারেন না। তবুও এক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও জরিমানা করা হয়। কালো ধোঁয়ার জন্য তাদের ডিজেল পাম্প অর্থাৎ ফুয়েল ইনজেক্টার টেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী যানবাহনের বায়ু অপসারণ রোধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশ কর্তৃপক্ষকে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা দেয়া আছে। ঐ আইনে বিআরটিএ -কে যথাযথ পরীক্ষাপূর্বক যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষমতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত কোন ব্যক্তিকে দূষণক্ষম যানবাহন জব্দ বা আটক করার ক্ষমতা প্রদান করা যাবে; কিন্তু আইনে কে উপযুক্ত ব্যক্তি হবেন কিংবা কিভাবে পরীক্ষা করা হবে তার কোন ব্যাখ্যা বা নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি।
জাতীয় পরিবেশ সংরণ অধ্যাদেশ ’৯৪ অনুযায়ী আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান কঠোর করা হয়েছে। এই আইন গাড়ীর ত্রæটির জন্য ড্রাইভারকে দায়ী করে ড্রাইভিং লাইসেন্সে তা রেকর্ড করার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে একজন চালককে দায়ী করা ঠিক হবে কি? গাড়ীর ক্রটির জন্য এককভাবে তাকে দায়ী করা ঠিক হবে কিনা, যেখানে ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন মালিকসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষ। তাই এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবী রাখে। চালক ও মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা আদায়ের মধ্যেই ধোঁয়া নির্গমন নিরসন হতে পারে না। সে সঙ্গে অন্যদের ভ‚মিকাটাও দেখা উচিত। ❏